রাফসান জনি (কালীগঞ্জ)ঝিনাইদহঃ ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ১২ আওলিয়ার বারবাজার। প্রত্নতাত্তিক নির্দশন সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক স্থানটি অবস্থিত জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। বারবাজার এলাকার বিভিন্ন স্থানটিকে ঘিরে মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা কৌতুহল। গৌরবের বারবাজার কারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা সঠিক ভাবে কেউ বলতে পারে না। একদলের মতে, সিলেট অঞ্চল থেকে ১২ জন আওলিয়া হযরত বড়খান গাজীর সঙ্গে এসে এখানে আস্তানা গাড়েন, সেই থেকে বারবাজার নামের উৎপত্তি। আবার অনেকের মতে, খানজাহান আলী (রাঃ) এর সঙ্গে ১১ জন দরবেশ বাগেরহাট পৌঁছানোর আগে সুন্দরবন অঞ্চল ও এর আশপাশে ইসলাম প্রচার করতেন। তাঁরাই এখানে অবস্থান করতেন বলে এই নামকরণ করা হয়। কারো মতে, ১২টি বাজার নিয়ে গঠিত বলেই এলাকার নাম দেওয়া হয়েছিল বারবাজার। প্রাচীন এই জনপদের পরিধি ছিল ১০ বর্গমাইল। তন্মধ্যে গড়ে ওঠে খোশালপুর, পিরোজপুর, বাদুরগাছা, সাদেকপুর, এনায়েতপুর, মুরাদগড়, রহমতপুর, মোল্লাডাঙ্গা, বাদোদিহি, দৌলতপুর, সাদগাছি ও বেলাট নামের ১২টি বাজার। কথিত আছে, ১২ জন পীর আওলিয়ার নামে বারবাজারের নামকরণ হয়। তাঁরা হলেন হযরত বড়খান গাজীর সঙ্গীও ছিলেন। গ্রাম গুলো হলো এনায়েত খাঁর এনায়েতপুর, আবদাল খাঁর নামে আবদালপুর, দৌলত খাঁর নামে দৌলতপুর, রহমত খাঁর নামে রহমতপুর, শমসের খাঁর নামে শমসেরপুর, মুরাদ খাঁর নামে মুরাদগড়, হৈবত খাঁর নামে হৈবতপুর, নিয়ামত খাঁর নামে নিয়ামতপুর, সৈয়দ খাঁর নামে সৈয়দপুর, বেলায়েত খাঁর নামে বেলাত বা (বেলাটনগর) ও শাহাবাজ খাঁর নামে শাহাবাজপুর। এসব আওলিয়ার নামে কেবল বারবাজার নয়, পার্শ্ববর্তী অনেক গ্রামগঞ্জের নামও তাঁদের নামানুসারে রাখা হয়েছে।তবে, ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায়, বারবাজারে হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজাদের রাজধানী ছিল। গ্রিক ইতিহাসে পেরিপাসে প্রথম শতকে যে গঙ্গারিডি বা গাঙ্গেয় রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় তা এর নদী বিধৌত এলাকা। এখানে গঙ্গারিডি নামের এক শক্তিশালী জাতি বাস করত। এদের রাজধানী ছিল বারবাজার। এখানকার প্রাচীন নাম গঙ্গারিজিয়া বা গঙ্গারোজিয়া বারবাজারে একদা সমতট রাজ্যের রাজধানী ছিল। সপ্তম শতকে এখানে বৌদ্ধ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ও হিন্দু শাসনামলে বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। খানজাহান আলীর আগমনের পূর্বেই গঙ্গারিজিয়া রাজ্যের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় এবং তিনি যখন বারবাজারে অবস্থান করতেন তখন এটি ছিল নামকরা বন্দর। এরপর এখানে পাল বংশ, সেন, মোগল, পাঠান, ইংরেজসহ বহু জাতির আবির্ভাব ঘটে।কীভাবে এ সমৃদ্ধশালী সৌন্দর্যময় গঙ্গারিজিয়া বা বৈরাটনগর বা বারবাজার ভগ্নস্তুপে পরিণত হয় তা স্পষ্ট নয়। কিংবদন্তি আছে, বঙ্গবিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী নদীয়া দখলের পর নদীয়ার দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে মনোযোগী না হয়ে উত্তরদিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর বিজিত রাজ্য উত্তরদিকে প্রশস্ত হতে থাকে। পরিশেষে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পৌত্র নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ-এর শাসনামলে যশোর ও খুলনা তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়। ওই অঞ্চলে তিনি বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন। বৃহত্তম খুলনা জেলার বাগেরহাটের পরশমণি শ্রেষ্ঠ আওলিয়া হযরত খানজাহান আলী। তিনি ১৬৫৯ সালে (৮৬৩) হিজরি ২৩ অক্টোবর পরলোক গমন ত্যাগ করেন। তিনি একসময় নিজের আত্মরক্ষায় একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতগঞ্জে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বৃহত্তর যশোর জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার হাকিমপুর হয়ে বারবাজার অভিমুখে রওনা দেন। পথে জনসাধারণের পানীয়জলের তীব্র কষ্ট দেখে তিনি এ অঞ্চলে অগণিত দীঘি আর পুকুর খনন করেন। কথিত আছে, একই রাতে এসব জলাশয় খনন করা হয়। বারবাজার অঞ্চলে ৮৪ একর পুকুর ও দীঘি এখনও বিদ্যমান। এ অঞ্চলে ১৮টি উল্লেখযোগ্য দীঘির নামানুসারে জানা যায়,পীরপুকুর (৪একর), গোড়ারপুকুর (৫ একর), সওদাগর দীঘি (১১ একর), সানাইদার পুকুর (৩ একর), সাতপীরের পুকুর (৩ একর), ভাইবোনের দীঘি (৪ একর), আনন্দ (২ একর), গলাকাটা দীঘি (৪ একর), জোড়াবাংলা দীঘি (৩ একর), চোরাগদা দীঘি (৪ একর), মাতারাণী দীঘি (৮ একর), নুনোগোলা দীঘি (৩ একর), কানাই দীঘি (৩ একর), পাঁচ পীরের দীঘি (৩ একর), মনোহর দীঘি (৩ একর), আদিনা দীঘি (৩ একর), শ্রীরাম রাজার দীঘি (১০ একর) ও বেড় দীঘি (৮ একর)। মোট ৮৪ একর জুড়ে এসব দীঘি। খানজাহান আলীর এক যুগ সাধনার স্থাপত্য নিদর্শন রয়ে গেছে এই বারবাজারে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নিদর্শন ৩২ গম্বুজ বিশিষ্ট সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ ও বারবাজার গলাকাটা দীঘির ৬ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলো ১৯৯৩ সালে খননের ফলে প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন প্রত্নতত্বের সন্ধান মিললেও এখানে কোনো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। মাটি সরিয়ে অভিনব সব স্থাপনা আবিষ্কার করা হলেও তার ইতিহাস ‘মাটিচাপাই’ আছে। কালীগঞ্জ শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে বারোবাজারের অবস্থান। বারো আউলিয়া, খানজাহান আলী, গাজী কালু চম্পাবতী, গঙ্গারিডিসহ বারোবাজারের ইতিহাসের শেষ নেই। বারোবাজারের রেললাইনের পশ্চিম পাশে তিন বর্গকিলোমিটার জায়গার মধ্যে প্রত্নতত্বের বিভাগ মাটি খুঁড়ে মসজিদসহ ১৫টি প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের সন্ধান পেয়েছে।এগুলো হলো সাতগাছিয়া মসজিদ, ঘোপের ঢিপি কবরস্থান, নামাজগাহ কবরস্থান, গলাকাটা মসজিদ, জোড়বাংলা মসজিদ, মনোহর মসজিদ, জাহাজঘাটা, দমদম প্রত্নস্থান, গোড়ার মসজিদ, পীর পুকুর মসজিদ, শুকুর মল্লিক মসজিদ, নুনগোলা মসজিদ, খড়ের দীঘি কবরস্থান, পাঠাগার মসজিদ ও বাদেডিহি কবরস্থান। ১৯৯৩ সাল থেকে খনন করে এ পর্যন্ত নিদর্শন গুলো উদ্ধার করা হয়। প্রত্নত্বক বিভাগ নিদর্শনের এ স্থানটির নাম দিয়েছে ‘শহর মোহাম্মদাবাদ’। মনে করা হয়, এসব পঞ্চদশ শতাব্দীর কীর্তি। তবে ১৯৯৩ সালে জোড়বাংলা মসজিদ খননের সময় একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। তাতে লেখা ছিল শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে পুসাইন ৮০০ হিজরি। শিলালিপিটি এখানকার প্রত্নতত্বের অন্যতম দলিল। এ থেকেই বোঝা যায়, নিদর্শন গুলো প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন। বেশির ভাগ নিদর্শনের পাশে বিরাট বিরাট দীঘি রয়েছে। বারবাজার বেলাট দৌলতপুরে কারুকাজ খচিত বর্গাকৃতির মসজিদটি ৪ গম্বুজ বিশিষ্ট। মূল ভবনের সঙ্গে চারকোনে আটকোন বিশিষ্ট স্তম্ভ এবং বারান্দার সঙ্গে আরো দুটি স্তম্ভ। মসজিদটির মেহরাব ও দেওয়াল বিভিন্ন নকশা সজ্জিত। মসজিদের অভ্যন্তরে চারি দেওয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত আটটি ইটের তৈরি কেবলা দেওয়ালে ও মেহরাবে পোড়া মাটির নকশা, শিকল নকশা, বৃক্ষপত্রাদির নকশা পুষ্পশোভিত পোড়া মাটির নকশা খঁচিত। মসজিদের পূর্বপাশে একটি বিশাল দীঘি রয়েছে। বারবাজার তাহেরপুর রাস্তার বাম পাশে জোড়বাংলা মসজিদটি অবস্থিত। প্রচলিত লোককথা মতে, মসজিদের কাছাকাছি জোড়া কুঁড়ে ঘর ছিল। এ কারণেই হয়তো মসজিদটির নামকরণ জোড়বাংলা হয়ে থাকবে। ধারণা করা হয় এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি সুলতান গিয়াস উদ্দীন মাহমুদ শাহের শাসন আমলে নির্মিত। মসজিদের পূর্ব পাশে তিনটি সুচালো খিলান যুক্ত প্রবেশ পথ। মসজিদের চার কোণে আটকোণ বিশিষ্ট চারটি কারুকাজ খঁচিত টাওয়ার রয়েছে। বারবাজার হাসিল বাগে অবস্থিত নুনগোলা মসজিদটিও বর্গাকৃতির একটি মসজিদ। মসজিদটিতে তিনটি অর্ধবৃত্তাকৃতির মেহরাব। মেহরাবে ছোট ছোট বর্গাকৃতির মধ্যে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা। মসজিদের বাইরের দেওয়ালে পর্যায়ক্রমিক খাড়া চাল ও খাজ আছে। এগুলোতে দিগন্ত রেখাকৃতির ছাচে গড়া নকশা ও বাঁধন আছে। মসজিদের ওপর একটি গম্বুজ রয়েছে। বারবাজার তাহেরপুর রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থিত গলাকাটা মসজিদটি সুলতানী আমলের আরেক অনিন্দ্য সুন্দর এক স্থাপত্য শিল্প। গোলাকার ঢিবির ওপর স্থাপিত মসজিদটির ভেতরের দিকের কেবলা দেওয়ালে তিনিটি অর্ধবৃত্তাকারাকৃতির সুসজ্জিত মেহরাব। মেহররাবের দুই পাশে পোড়া মাটির দিগন্ত রেখাকৃতির বাঁধন, বিভিন্ন ফুলের জ্যামিতিক নকশা আছে। এ ছাড়া পোড়া মাটির ঘণ্টা ও চেইন নকশা মসজিদের দেওয়াল ও ছাদজুড়ে। মসজিদের সঙ্গেই আছে একটি বিশাল দীঘি। এটি একটি বর্গাকাকৃতির এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। দেখতে অনেকটা ঢাকার বিনত বিবির মসজিদের মতো। মসজিদটির উভয় পাশে একটি করে বন্ধ মেহরাবসহ পশ্চিম পাশে একটি অর্ধবৃত্তাকৃতির মেহরাব আছে। এই মেহরাবগুলোতে আছে পোড়া মাটির ঘণ্টা ও চেইন নকশা। অপরূপ নকশাগুলো মানুষের হৃদয় ছুয়ে যায়। বারবাজারের এসব প্রত্নতাত্নিক নির্দশনের তেমন প্রচার না থাকায় পর্যটক শূন্য রয়েছে এলাকাটি। এ ছাড়া আবাসিক হোটেলসহ অন্যান্য সুব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকদের নজর কাড়তে ব্যর্থ হচ্ছে এ অঞ্চল। এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে পর্যটকদের উৎসাহী করতে পারলে এবং সরকারি ভাবে মসজিদ গুলোকে ঘিরে পরিকল্পিত ভাবে শোভাবর্ধনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারলে সরকারের পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষ আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারতো।
Leave a Reply