নিজস্ব প্রতিবেদক।।
আম—শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গ্রীষ্মকালীন এই রসালো ফলটি তার স্বাদ, ঘ্রাণ ও পুষ্টিগুণের জন্য বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। প্রকৃতির অনন্য উপহার এই ফলটি শুধুমাত্র স্বাদেই নয়, শরীরের জন্য উপকারী নানা উপাদানেও সমৃদ্ধ।
পুষ্টিগুণে ভরপুর আম
আমকে বলা হয় ‘ফলের রাজা’। এক কাপ পাকা আমের মধ্যে থাকে প্রায় ১০০ ক্যালোরি শক্তি, প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও এ, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এতে আছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আঁশ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং প্রাকৃতিক চিনি। নিয়মিত আম খাওয়া চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং হজম শক্তি উন্নত করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আম একটি প্রাকৃতিক ‘ইমিউন বুস্টার’। করোনাকালীন সময়ে এর চাহিদা আরও বেড়ে গিয়েছিল পুষ্টির জন্য।
মৌসুমি ফল হলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে বারোমাসি আম
আম মূলত একটি মৌসুমি ফল। বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আম পাওয়া যায়। তবে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও নতুন জাতের উদ্ভাবনের ফলে এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে বারোমাসি আম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, নওগাঁ—এইসব এলাকায় গড়ে উঠেছে বারোমাসি আমের বাগান। ‘বারোমাসি গুটি’, ‘আম্রপালি’, ‘কালিভোগ’, ‘গোলাপখাস’, ‘হিমসাগর বারোমাসি’ সহ আরও কয়েকটি জাত এখন চাষ হচ্ছে বছরের বিভিন্ন সময়ে।
এই জাতের আমের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এটি নির্দিষ্ট যত্ন ও পরিকল্পনার মাধ্যমে চাষ করলে বছরজুড়েই ফলন পাওয়া যায়। কৃষকরা এতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কারণ এটি শুধু মৌসুমি আয়ের উপর নির্ভর না করে সারাবছরের আয়ের পথ খুলে দিচ্ছে।
অর্থনীতিতে আমের অবদান
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১২-১৫ লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। এর একটি বড় অংশ দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও কিছু এশিয়ান দেশে বাংলাদেশের আমের চাহিদা বেড়েছে।
বারোমাসি আম উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে এখন আম রপ্তানি আরও সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা করা যাচ্ছে, যা দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে। সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বারোমাসি আম চাষে সহায়তা দিচ্ছে।
কৃষকের মুখে হাসি, ভোক্তার খাবারে বৈচিত্র্য
এক সময় কৃষকেরা শুধু গ্রীষ্মে আম বিক্রি করে উপার্জন করতেন। এখন বারোমাসি আমের চাষের মাধ্যমে তারা বছরের বেশিরভাগ সময়েই বাজারে আম বিক্রি করতে পারছেন।
অন্যদিকে, ভোক্তারাও উপকৃত হচ্ছেন—গ্রীষ্মকাল পেরিয়ে গেলেও বাজারে সহজে আম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ঘরোয়া খাবারে, অতিথি আপ্যায়নে, জুস-ডেজার্ট কিংবা শিশুদের টিফিনে আমের ব্যবহার বাড়ছে।
বিশেষ সতর্কতা
যদিও আম পুষ্টিকর, তবে পরিমিতভাবে খাওয়া উচিত। বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য অতিরিক্ত পাকা আম ক্ষতিকর হতে পারে। তাছাড়া রাসায়নিকভাবে পাকানো আম মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর—তাই স্বাভাবিক উপায়ে পাকানো আম গ্রহণ করাই নিরাপদ।
উপসংহার
আম শুধু একটি মৌসুমি ফল নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। এখন যখন সারা বছরই বারোমাসি আম পাওয়া যাচ্ছে, তখন দেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। পুষ্টিগুণ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় ভরপুর আমের গুরুত্ব আমাদের জীবনে আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
Leave a Reply