আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তান আবারও মুখোমুখি অবস্থানে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দুই দেশের সামরিক নেতৃত্বের পারস্পরিক হুমকি, পাল্টা জবাব ও কড়া ভাষার বিবৃতি ঘিরে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। ১৯৭১ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সীমান্তে সংঘর্ষ, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে অভিযোগ এবং কাশ্মীর ইস্যুতে দ্বন্দ্ব থাকলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক মোড় নিয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত।
ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী সম্প্রতি এক বক্তব্যে পাকিস্তানকে সরাসরি হুমকি দিয়েছেন। তার দাবি, যদি পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে যায়, তাহলে “ইতিহাস ও ভূগোলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।”
এই বক্তব্যকে পাকিস্তান যুদ্ধ উসকে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছে। পাশাপাশি ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধান অমর প্রীত সিংও দাবি করেছেন, চলতি বছরের মে মাসে দুই দেশের সংঘর্ষে ভারত পাকিস্তানের পাঁচটি যুদ্ধবিমান গুলি করে নামিয়েছে—যদিও তার পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।
ভারতের বক্তব্যের জবাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, এসব উসকানিমূলক মন্তব্য পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। আইএসপিআর (Inter-Services Public Relations) বলেছে, ভারত নিজেদের ভুক্তভোগী হিসেবে দেখালেও বাস্তবে তারাই সহিংসতা উসকে দিচ্ছে।
পাকিস্তান স্পষ্ট করে দিয়েছে, কোনো আগ্রাসন হলে “জবাব হবে দ্রুত, চূড়ান্ত এবং বিধ্বংসী।” তাদের নতুন প্রতিক্রিয়া নীতিতে সংযম বা দ্বিধার জায়গা নেই। সেনাবাহিনী আরও জানায়, তারা শুধু সীমান্তেই নয়, শত্রুর ভেতরেও আঘাত হানার সক্ষমতা রাখে।
চলতি বছরের মে মাসে দুই দেশের সীমান্তে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। ভারতের পর্যটকবাহী গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর নয়াদিল্লি ইসলামাবাদকে দায়ী করে। এর পরপরই ভারত ব্যাপক পাল্টা হামলা চালায়, যেখানে বেসামরিক নাগরিকরাও নিহত হয় বলে অভিযোগ পাকিস্তানের।
জবাবে পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনিয়ান-উম-মারসুস’ চালিয়ে ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ও এক ডজন ড্রোন গুলি করে নামানোর দাবি করে। চার দিন ধরে চলা সংঘর্ষ শেষ হয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এক অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে।
পাকিস্তানি নিরাপত্তা সূত্রগুলোর দাবি, ভারতের সাম্প্রতিক হুমকি “ফাঁপা গর্জন” ছাড়া কিছু নয়। তবে তারা সতর্ক করেছে, এবার জবাব হবে “আগের চেয়েও কঠোর”।
ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি ও যুদ্ধ প্রস্তুতি নেওয়ার তথ্যও সামনে এসেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি তৈরি করছে।
পাকিস্তান আরও অভিযোগ করেছে, আফগানিস্তানের ভূখণ্ড এখনো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে, যদিও এসব বিষয়ে কাবুল সরকারকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে।
পাকিস্তান জানায়, ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর ইস্যুতে তাদের অবস্থান আগের মতোই অটল। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নীতিতেও কোনো পরিবর্তন নেই। গাজায় চলমান “গণহত্যা ও নিপীড়ন” বন্ধ করার আহ্বান জানায় ইসলামাবাদ।
এদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারিত্বও জোরদার হচ্ছে। পাসনি বন্দরসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়ার কথা জানিয়ে দেশটি বলছে, “এই শতাব্দী হবে খনিজসম্পদের শতাব্দী”, এবং পাকিস্তান তার স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের এই উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। দুই দেশের পারমাণবিক সক্ষমতা যেকোনো সংঘাতকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
তবে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরবের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো মধ্যস্থতা করে দুই দেশের মধ্যে সংলাপের সুযোগ তৈরি করবে—যাতে আরেকটি “কারগিল” বা “পুলওয়ামা”-র পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—উত্তেজনা যত বাড়ে, সংলাপের দরজা তত বন্ধ হয়। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এখন সবচেয়ে প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় কূটনৈতিক সমাধান খোঁজা।
অন্যথায়, সীমান্তের আগুন যে কোনো সময় পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
Leave a Reply