ভূমিকা
জমি, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবনযাত্রার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। সভ্যতার শুরু থেকেই জমি মালিকানা ছিল শক্তি ও সম্পদের প্রতীক। প্রাচীন যুগের শাসকগোষ্ঠী থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জমি মালিকানা ধারণা ক্রমশ পরিবর্তিত হয়েছে এবং কিভাবে বিভিন্ন সময়কালে এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তা জানবো।
প্রাচীন যুগের জমি মালিকানা
প্রাচীন সভ্যতাগুলো, যেমন মেসোপটেমিয়া, মিশর, এবং সিন্ধু সভ্যতা, জমি মালিকানার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এই যুগে জমি সাধারণত শাসক বা রাজপরিবারের অধীনে ছিল, এবং প্রজারা জমিতে কাজ করতো। জমির অধিকার ছিল মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক। উদাহরণস্বরূপ, মিশরে ফারাওরা জমির মালিক ছিলেন, এবং প্রজারা তাদের জমিতে কৃষিকাজ করে জীবনযাপন করতো।ভারতে, বৈদিক যুগে জমির মালিকানা শাসক ও ব্রাহ্মণদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। জমি মূলত কৃষিজীবীদের দ্বারা চাষ করা হতো, কিন্তু তাদের জমির উপর নিজস্ব অধিকার ছিল না। জমির উৎপাদন থেকে শাসকরা কর সংগ্রহ করতো এবং এই প্রথা বিভিন্ন যুগে পরিবর্তিত হয়েছে।
মধ্যযুগের জমি মালিকানা
মধ্যযুগে জমির মালিকানা ব্যবস্থা ছিল রাজতন্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা জমির মালিকানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। জমি ছিল রাজাদের সম্পত্তি, এবং তারা এই জমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সামন্ত প্রভুদের অর্পণ করতেন। প্রজারা সেই জমিতে কাজ করতো এবং সামন্ত প্রভুদের কর প্রদান করতো। জমির মালিকানার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটে এবং জমির উপর নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
ভারতে মুঘল শাসনামলে জমিদার ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। জমিদাররা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে জমির মালিকানা পেতো এবং তারা প্রজাদের থেকে কর আদায় করতো। জমির মালিকানা ছিল শাসকদের ক্ষমতা ধরে রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
ঔপনিবেশিক যুগের জমির মালিকানা
ঔপনিবেশিক শাসনকাল, বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসনের সময়, জমির মালিকানার ধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ব্রিটিশরা “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” নামক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যেখানে জমিদাররা জমির মালিকানা লাভ করে এবং কৃষকরা চাষ করতে বাধ্য হয়। এই ব্যবস্থায় জমির উপর কৃষকদের অধিকার ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ে এবং জমিদারদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ব্রিটিশ শাসনে জমি নিয়ে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয় যা কৃষকদের শোষণের দিকে ধাবিত করে। এই শাসনামলে জমির মালিকানা এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আধুনিক যুগের জমি মালিকানা
স্বাধীনতার পর আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জমি মালিকানার পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। বিভিন্ন দেশে জমি সংস্কার আইন প্রণয়ন করা হয়, যার ফলে জমিদার প্রথার অবসান ঘটে এবং কৃষকদের জমির মালিকানা প্রদান করা হয়।
ভারতে ভূমি সংস্কার আইন প্রণীত হয় যাতে জমির অধিকার কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং জমির উপর জমিদারদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত হয়। এই পরিবর্তন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার
জমি মালিকানার ইতিহাস বিভিন্ন সময়কালে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত জমির মালিকানা ধারার পরিবর্তন ঘটে এবং এটি মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। আজকের দিনে জমি মালিকানা শুধুমাত্র সম্পদ বা ক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। জমির উপর মানুষের অধিকার ও এর ব্যবস্থাপনা ভবিষ্যতে আরও উন্নত ও সমতামূলক হতে পারে, যা একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজের দিকে ধাবিত করবে।
মোঃ রাশেদুল হক রিগান
অ্যাডভোকেট জজ কোট ঝিনাইদহ
Leave a Reply